খোঁজ খবর ডেস্ক: দেশে সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে নতুন নীতিমালা চালু হওয়ায় চলতি বছর সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে অক্টোবর মাসে মাত্র ৮২২ কোটি টাকায় দাড়িয়েছে। একক মাস হিসেবে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির এই হিসাব সবচেয়ে কম। অথচ আগের বছরের (২০১৮) একই মাসে যা ছিল ৪ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে থেকে জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে এই বছরের অক্টোবরে বিক্রি কমেছে ৩ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে এই ধারাবাহিক ভাটায় অর্থনীতিতে স্থবিরতার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
গত চার মাস ধরে অব্যাহতভাবে কমায় চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। আগস্টে বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ২০৫ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বরে বিক্রি হয়েছে ৯৮৫ কোটি টাকা। আর অক্টোবর মাসে বিক্রি হয়েছে মাত্র ৮২২ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি। অর্থনীতির ভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়। অব্যাহতভাবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়াকে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির স্থবিরতার ইঙ্গিত বলে মন্তব্য করেছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক ঋণে সুদের হার কমানোর পাশাপাশি সরকারের ব্যয় কমানোর অংশ হিসেবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাতে সত্যিকার অর্থে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।’ ব্যক্তিখাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করে অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়ে গেছে।’
তবে, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখতে-এর মতে, ‘বেশ কিছু কঠিন নিয়ম-কানুন জারি করার ফলে সঞ্চয়পত্র খাতে বেনামে ও কালো টাকার বিনিয়োগ কমে এসেছে।’ তার মতে, ‘টিআইএন এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক করায় অনেকেই আগের মতো সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। তবে এখন যারা করছেন তারাই প্রকৃত বা জেনুইন।’
অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু কঠিন নিয়ম-কানুন জারি করা হয়েছে। এতে যারা সঞ্চয় করার সুযোগ পেতো, তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার সঞ্চয়পত্রে কড়াকড়ি আরোপের ফলে ব্যাংক খাতেও উন্নতি হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের নীতিনির্ধারকরাও সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমাতে চেয়েছিলেন। ধারণা করা হচ্ছিল, সঞ্চয়পত্রে কড়াকড়ি আরোপ করলে ব্যাংকের আমানত বাড়বে। এতে কম সুদে ব্যবসায়ীরা ঋণ নিতে পারবেন। কিন্তু দেখা গেলো, ব্যাংক ঋণে সুদের হার কমলো না, ব্যক্তিখাতে ঋণও বাড়লো না। এর ফলে অর্থনীতিতে গতি আসার বদলে এক ধরনের অচলাবস্থা চলছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৫ হাজার ৫১২ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১৭ হাজার ৮২৮ কোটি টাকার। অর্থাৎ গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসের তুলনায় এ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে ১২ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, বাজেট ঘাটতি পূরণে প্রতিবছরই সরকার সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ঋণ নেয়। এই অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা ধার করার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। গত অর্থবছরের মূল বাজেটে এই খাত থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও অর্থবছর শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকায়, যা সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ পড়ার কারণে এই খাত থেকে ঋণ নেওয়া কমিয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছিল। এরই অংশ হিসেবে চলতি অর্থবছরে পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া ১ লাখ টাকার বেশি মূল্যমানের সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একই ব্যক্তির একাধিক জায়গা থেকে সঞ্চয়পত্র কেনা ঠেকাতেও নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। একজন ব্যক্তির জন্য সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া দুর্নীতি কিংবা কালো টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধে ক্রেতার তথ্যের একটি ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। ফলে অনেকেই আর আগের মতো সঞ্চয়পত্র কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না ।
দেশে বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্রের মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র এবং তিন বছর মেয়াদি ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র। এগুলোর গড় সুদের হার ১১ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সব শাখা অফিস, বাণিজ্যিক ব্যাংকের নির্ধারিত শাখা, জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরো অফিস ও পোস্ট অফিস থেকে সঞ্চয়পত্র কেনা যায়।