
খোঁজ খবর রিপোর্ট: গাইবান্ধায় সুদের টাকা আদায়ের জন্য নিহত জুতা ব্যবসায়ী হাসান আলীকে (৪৫) একমাস নিজের বাসায় আটকে রেখে নির্যাতন করেন জেলা আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক মাসুদ রানা। ৩৬ দিন পর তার বাসা থেকে আজ শনিবার দুপুরে হাসানের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গাইবান্ধা জেলা শহরের খানকা শরীফ সংলগ্ন নারায়নপুর এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতার বাসা থেকে এই লাশ উদ্ধার করা হয়।
এলাকাবাসি ও নিহতের পারিবারিক সুত্রে জানা গেছে, গাইবান্ধা জেলা শহরের থানাপাড়া এলাকার মৃত হজরত আলীর ছেলে হাসান আলী। তিনি জুতা ব্যবসা করতেন। শহরের স্টেশন রোডে তার জুতার দোকান রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদ রানা(৪৮) একজন দাদন ব্যবসায়ী। তিনি থানার দলালি করেন বলেও এলাকায় কথিত আছে। তিনি নিজেকে পুলিশের এসআই পরিচয় দিয়ে সাদালন মানুষের সাথে প্রতারণাও করে থাকেন। দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে তিনি দাদন(সুদের) ব্যবসা করেন। প্রায় দুইবছর আগে মাসুদ রানার কাছ থেকে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন হাসান আলী। এই টাকা সুদাসলে বর্তমানে ১৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকা দাড়িয়েছে বলে দাবি করেন মাসুদ রানার স্ত্রী রেহেনা পারভীন। সম্প্রতি মাসুদ রানা সুদের টাকার জন্য হাসান আলীকে চাপ দেন। টাকা দিতে না পারায় গত ৫ মার্চ মাসুদ রানা লালমনিরহাটের একটি বিয়ে বাড়ি থেকে মোটরসাইকেল যোগে করে হাসান আলীকে ধরে আনতে যায়। এসময় স্থানীয় লোকজন হাসান আলীকে ছাড়াতে গেলে মাসুদ রানা নিজেকে গাইবান্ধা জেলা পুলিশের এসআই পরিচয় দেয় এবং তার বিরুদ্ধে মামলা আছে বলে জানায়। পরে সেখান থেকে মোটরসাইকেল যোগে হাসান আলীকে সদর উপজেলার বল্লমঝাড় ইউনিয়নের নারায়নপুর গ্রামে নিজ বাড়িতে নিয়ে এসে আটক করে রাখেন মাসুদ রানা।

নিহত হাসান আলীর স্ত্রী বিথী বেগম স্বামীকে উদ্ধারের জন্য গাইবান্ধা সদর থানায় অভিযোগ করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওইদিন সন্ধ্যায় সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মজিবর রহমান, উপ-পরিদর্শক মোশারফ হোসেন ও আসাদ আওয়ামীলীগ নেতা ও দাদন ব্যবসায়ী মাসুদ রানার বাড়ি যায়। সেখান থেকে মাসুদ রানাসহ হাসান আলীকে নিয়ে থানায় আসে। সন্ধ্যায় সদর থানা চত্বরে শালিশ বৈঠক বসে। সদর থানার উপ-পরিদর্শক মোশারফ হোসেন ও আসাদ উভয় পক্ষকে নিয়ে শালিশ বৈঠক করেন।
নিহত হাসান আলীর স্ত্রী বিথী বেগম অভিযোগ করেন, শালিশ বৈঠকে আমার কাছে পুরো টাকা ফেরত ও স্টাম্পে সই চান মাসুদ রানা। এতে আমি অস্বীকৃতি জানালে পুলিশ আমার স্বামীকে মাসুদ রানার হাতে তুলে দেন। তারপর থেকে আমার স্বামী মাসুদ রানার বাসায় ছিলেন। তিনি অভিযোগ করেন, টাকা নিয়ে আমার স্বামীর সঙ্গে মাসুদ রানার তর্কবিতর্ক হয়। টাকার জন্য তিনি আমার স্বামীকে মানষিক ও শারীরক নির্যাতন এবং নানা ধরণের হুমকি দেন। এসব নির্যাতনের কথা মোবাইল ফোনে জানতে পেরে আমি থানায় অভিযোগ করেছিলাম। কিন্তু পুলিশ আমার স্বামীকে উদ্ধার করে দেয়নি। আমার কাছেও স্বামীকে ফেরত দেয়নি। উল্টো তাকে মাসুদ রানার হাতে তুলে দেওয়া হয়। নির্যাতনের কারণে আমার স্বামী মারা গেছে। তারপর আমার স্বামীকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

এলাকাবাসির অভিযোগ, দাদন বা ঋণ গ্রহীতা কোন ব্যক্তি দাদনের টাকা সময়মত দিতে না পারলে ওই ব্যক্তিকে মাসুদ রানা তার বাড়িতে নিয়ে আটকে রাখতো। তারই ধারাবাহিকতায় হাসান আলী দাদনের টাকা পরিশোধ না করায় তাকে এক মাসের বেশী সময় ধরে আটক রাখার পর আজ তার লাশ ওই বাড়ি থেকে বের করে।
শালিশের নামে মাসুদের হাতে হাসানকে তুলে দেওয়া প্রসঙ্গে গাইবান্ধা সদর থানার ওসি মো. মাহফুজার রহমান বলেন, পুলিশ মাসুদ রানার হাতে হাসান আলীকে তুলে দেয়নি। থানা চত্বরে শালিশ বৈঠকের পর হাসান আলী, তার স্ত্রী বিথী বেগম ও মাসুদ রানাসহ উভয়পক্ষের লোকজন থানা থেকে বেড়িয়ে যায়।
এক মাস ধরে হাসান আলীকে বাড়িতে রাখার কথা স্বীকার করে মাসুদ রানার স্ত্রী রেহেনা পারভীন বলেন, আমার স্বামী মাসুদ রানার সাথে ব্যবসায়ীক কারণে হাসান আলীর লেনদেন ছিল। গত এক মাস ধরে তিনি আমাদের বাসায় আছেন। আজ শনিবার সকাল নয়টা পর্যন্ত হাসান আলী ঘুম থেকে জেগে উঠেননি। পরে বাড়ির লোকজন বাথ রুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে দেখতে পায় হাসান আলী লাশ বাথরুমের ধরনার সাথে ঝুলে আছে। পরে পুলিশকে খবর দেয়া হয়। দুপুর ১২টার দিকে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যায়। লাশ উদ্ধারের সময় গলায় কাপড় পেঁচানো ছিল ও হাসান আলীর লাশের পায়ের হাটু টুলের উপরে ভাঁজ করা ছিল।

এব্যাপারে হাসান আলীর স্ত্রী বিথি বেগম ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, হাসান আলীকে হত্যা করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। পরে পুলিশ আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদ রানাকে হ্যান্ডকাপ ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে এলাকার লোকজন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং তাকে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে ও কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়ার দাবি জানায়। এসময় বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশের উপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পরে থানা থেকে আরও পুলিশ গিয়ে মাসুদ রানার হাতে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে এবং হেলমেট পরিয়ে তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এই ঘটনায় শনিবার বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছিল।
জানতে চাইলে গাইবান্ধা সদর থানার ওসি মো. মাহফুজার রহমান বলেন, লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নিহতের মরদেহ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য জেলা হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। তবে হত্যা না আত্মহত্যা তা ময়না তদন্তের প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। আটককৃত আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদ রানাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড চাওয়া হবে।
তবে তার স্ত্রী রেহেনা পারভীন তাদের বাসায় হাসান আলীকে পাওনা টাকা(১৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকা) আদায়ের জন্য এক মাসের বেশী সময় আটক রাখার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে কিভাবে হাসান আলী মারা গেলেন, সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।